নিজস্ব প্রতিবেদক
বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী একটি ধর্মভিত্তিক (ইসলামী) দল হলেও সম্প্রতি তারা ভিন্ন ধর্মের বিশেষ করে হিন্দু ধর্মের অনুসারীদের দলে টানছে। এতে অনেকটাই সফলতা দেখিয়েছে দলটি। তবে যে আশায় বা উদ্দ্যেশে জামায়াত হিন্দুদের কাছে টানছে তাতে তারা কতটা লাভবান হবে তা নিয়ে সংশয় আছে রাজনৈতিক মহলে।
গত শুক্রবার (৩১ অক্টোবর)দক্ষিণের জেলা খুলনার ডুমুরিয়ায় শুধুমাত্র সনাতন ধর্মাবলম্বীদের নিয়ে জামায়াতের একটি হিন্দু সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়েছে। দেশে জামায়াতের মতো ইসলামপন্থি দলে সনাতন ধর্মাবলম্বীদের যোগদানের কথা অতীতে সেভাবে শোনা যায়নি।
খুলনার হিন্দু সম্মেলনে জামায়াতে ইসলামীর কেন্দ্রীয় সেক্রেটারি জেনারেল মিয়া গোলাম পরওয়ার বলেছেন, ‘যারা দাঁড়িপাল্লার জোয়ার দেখে হিন্দু সম্প্রদায়কে ভয়-ভীতির হুমকি দিচ্ছে, তাদের হুমকিতে এবার হিন্দুরা ভয় পাবে না। হিন্দুদের কেউ বাধা দিলে জনগণ প্রতিরোধ গড়ে তুলবে। এখন হিন্দুদের স্লোগান “সব মার্কা দেখা শেষ, দাঁড়িপাল্লার বাংলাদেশ’।
সম্মেলনে সভাপতির বক্তব্যে কৃষ্ণ নন্দী বলেন, ‘নতুন প্রজন্মের প্রথম ভোট দাঁড়িপাল্লার পক্ষে হোক। আগামী নির্বাচনে দাঁড়িপাল্লায় ভোট দিয়ে মিয়া গোলাম পরওয়ারকে সর্বোচ্চ ভোটে নির্বাচিত করার আহ্বান জানান তিনি।

সম্মেলনে মতুয়া সংঘের সভাপতি ডা. সুদীপ্ত কুমার সুন্দর মন্ডল বলেন, ‘আমরা আর ‘সংখ্যালঘু’ বলে পরিচয় শুনতে চাই না। আমরা সবাই বাংলাদেশি। স্বাধীনতার পর কোনো সরকার হিন্দুদের দাবিতে কাজ করেনি। এবার প্রমাণ হবে- হিন্দু মানেই কোনো নির্দিষ্ট দল নয়।’
তবে সম্প্রতি এসব খবর সামনে আসার পর প্রশ্ন উঠছে– দলটিতে ভিন্ন ধর্মের অনুসারীদের যোগদান বা অন্তর্ভুক্তির সুযোগ বাস্তবিক অর্থে কতটা আছে? আর জামায়াতই বা কেন সংখ্যালঘুদের দলে নিতে আগ্রহ দেখাচ্ছে?
জামায়াত একটি ইসলামপন্থি রাজনৈতিক দল। এমন একটি দলে ভিন্ন ধর্মের কেউ কীভাবে যোগ দেবেন কিংবা যোগ দিলেও সেটা বাস্তবিক অর্থে দলে তাদের কোনো ভূমিকা রাখার সুযোগ থাকবে কি না তা নিয়ে বিতর্ক আছে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে জামায়াতে ইসলামীর কেন্দ্রীয় সেক্রেটারি জেনারেল মিয়া গোলাম পরওয়ার গণমাধ্যমে বলেন, জামায়াতের গঠনতন্ত্র মেনেই তারা সনাতন ধর্মাবলম্বীদের মধ্যে সমর্থক হিসেবে যারা ‘জামায়াতে আসতে আগ্রহী’ তাদের দলে অন্তর্ভুক্ত করছে।
তিনি বলেন, ‘আমাদের গঠনতন্ত্রেই অমুসলিমদের সদস্য হিসেবে অন্তর্ভুক্তির বিধান আছে। তবে তাদেরকে মুসলমানদের মতো কোনো শর্ত দেওয়া হয়নি। বলা হয়েছে, জামায়াতের শৃঙ্খলা মেনে চলা, রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নকে গুরুত্ব দেওয়া, দেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব রক্ষায় ভূমিকা রাখা এবং উপার্জনে অবৈধপন্থা অবলম্বন না করা। এমন চারটি শর্ত মানলেই ভিন্ন ধর্মের যে কেউ আমাদের সদস্য হতে পারবেন।’
তবে তার পরও প্রশ্ন আছে। বিশেষ করে প্রাথমিক সদস্য হিসেবে দলে থাকলেও দলটিতে ভিন্ন ধর্মের অনুসারীদের কার্যকর ভূমিকা রাখার সুযোগ বাস্তবে নেই বলেই সমালোচনা আছে।
এর কারণ হচ্ছে, জামায়াতে ইসলামীতে যোগ দিলেও দলের কোনো পর্যায়ের নেতৃত্ব কিংবা নীতি-নির্ধারণী পর্যায়ে ভিন্নধর্মের কারো যাওয়ার সুযোগ রাখা হয়নি দলটির গঠনতন্ত্রে। ফলে দলটি বাস্তবিক অর্থে কতটা সব ধর্মের অনুসারীদের দলে সুযোগ দিচ্ছে সেটা অস্পষ্ট।
গোলাম পরওয়ার বলেন, ‘তারা তাদের ফোরামে লিডার হবেন। মূল জামায়াতের নেতৃত্বে আসবার তো আমাদের বিধি-বিধান অনুযায়ী সুযোগ নেই। তারা তাদের কমিউনিটির লিডার হবেন। ওই কমিউিনিটির মধ্যে তারা কাজ করবেন, বিভিন্ন দায়িত্ব পালন করবেন, স্থানীয়ভাবে তাদের কোনো কমিটি হলে সেখানে তারাই নেতৃত্ব দেবেন।’
তাহলে দলটি কতটা অন্তর্ভূক্তিমূলক হলো? এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘তিনি তো আমার দলে যোগ দিলেই সহযোগী হয়ে গেলেন। এটা তো তার অন্তর্ভুক্তি হয়ে গেলো। তারপর তার স্টান্ডার্ড, যোগ্যতা, দক্ষতা কী আছে, কতটা আছে সেটা আবার আরেকটা চ্যাপ্টার’।
বাংলাদেশে সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীর হার প্রায় ১০ শতাংশ। দেশটির বিভিন্ন আসনে নির্বাচনে জয়-পরাজয় নির্ধারণে সংখ্যালঘু ভোট গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে। সেই ভোটগুলো নিজেদের করতে হিন্দুদের কাছে টানার এই প্রক্রিয়া বলে মনে করেন অনেকে।
গত ৫ই আগস্টের পর আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধ থাকায় সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীর ভোট কোন দিকে যাবে সেটা নিয়েই মূলত রাজনৈতিক মহলে জোর আলোচনা রয়েছে।
অনেকেই মনে করেন, সংখ্যালঘুদের মধ্যে বিএনপির অবস্থান থাকলেও ইসলামপন্থি দল হওয়াসহ ঐতিহাসিক বিভিন্ন কারণে জামায়াত সেখানে সুবিধাজনক অবস্থানে নেই। ফলে জামায়াত যে এখন তাদের ভাষায়, অমুসলিম সমর্থক বৃদ্ধিতে জোর দিচ্ছে, তার একটা বড় কারণ এই সংখ্যালঘু ভোটার আকৃষ্ট করা।
যেসব আসনে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক সংখ্যালঘু ভোটার আছে, সেগুলোতে নির্বাচনী প্রচারে সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীর ভোটারদের রাখা হবে। এ ছাড়াও নির্বাচনী কমিটিগুলোতেও তাদের স্থান দেওয়ার কৌশল নিয়েছে জামায়াত।
এ বিষয়ে জামায়াত নেতা পরওয়ার বলেন, সংখ্যালঘু কিংবা হিন্দু ভোটারদের ভোটব্যাংক হিসেবে নয়, বরং নাগরিক হিসেবেই তারা বিবেচনা করেন। তারা ভোটার, এটা তো অস্বীকার করার উপায় নেই। কিন্তু এটাই তো সবকিছু নয়। আমরা তাদেরকে ভোটব্যাংক হিসেবে বিবেচনা করছি না, আমরা তাদের পাশে থাকতে চাই’।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান ঐক্যপরিষদের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক মনীন্দ্র কুমার নাথ বলেন, ‘তারা যেহেতু একটা ধর্মভিত্তিক দল, তাদের যে ধরনের চিন্তা-চেতনা, গঠনতন্ত্র, সেখানে অন্য ধর্মের লোককে ধারণ করার সুযোগ সেরকম নেই। এটা একটা ভোটের রাজনীতি, ভোটের সংখ্যা বাড়ানোর কৌশল’।
তিনি আরো বলেন, ‘তারা হিন্দুদের দলে নিলো, কিন্তু কোনো দায়িত্বপূর্ণ কাজ দিলো না, তাহলে সেটা তো ক্ষণস্থায়ী। এটা দীর্ঘস্থায়ী কোনো প্রভাব ফেলবে না। কার্যকর ভূমিকা রাখার সুযোগ না দিয়ে দলে ভিন্নধর্মের কাউকে অন্তর্ভুক্ত করলে সেটা বাস্তবে কোনো পরিবর্ত আনবে না’।



