― Advertisement ―

ভারতের সঙ্গে চুক্তির প্রতিবাদে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সামনে ছাত্র জোটের বিক্ষোভ

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভারত সফরে রেল কানেকটিভিটি বিষয়ে দুই দেশের মধ্যে সমঝোতা চুক্তির প্রতিবাদে পুলিশের বাধা অতিক্রম করে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সামনে বিক্ষোভ সমাবেশ করেছে...

দেশে তীব্র তাপদাহে বছরে ক্ষতি ২৪০০ কোটি টাকা

নিজস্ব প্রতিবেদক

জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে বৈশ্বিক উষ্ণতা সহ এর ক্রমবর্ধমান বিরূপ প্রভাব সরাসরি বাংলাদেশকে ক্ষতিগ্রস্থ করছে। প্রচণ্ড তাপজনিত কারণে শ্রম উৎপাদনশীলতা কমে যাওয়ায় গত বছর দুই হাজার ৪০০ কোটি টাকার (২৪ বিলিয়ন মার্কিন ডলার) সম্ভাব্য ক্ষতি হয়েছে বাংলাদেশের।

‘দ্য ল্যানসেট কাউন্টডাউন অন হেলথ অ্যান্ড ক্লাইমেট চেঞ্জ’-এর সদ্য প্রকাশিত প্রতিবেদনে জলবায়ু পরিবর্তনের ক্রমবর্ধমান বিরূপ প্রভাবে বাংলাদেশের স্বাস্থ্য ও অর্থনৈতিক সংকটের এমন চিত্র উঠে এসেছে।

তাপমাত্রা বাড়ার ফলে বেড়েছে গরমজনিত অসুস্থতা ও মৃত্যুর ঝুঁকি। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ১৯৫১ থেকে ১৯৬০—এই ১০ বছরের তুলনায় ২০১৫ থেকে ২০২৪—এই ১০ বছরে ডেঙ্গু সংক্রমণের আশঙ্কা বেড়েছে ৯০ শতাংশ।

প্রতিবেদন প্রকাশ উপলক্ষে গতকাল বৃহস্পতিবার (৩০ অক্টোবর) রাজধানীর ব্র্যাক সেন্টারে ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের সেন্টার ফর ক্লাইমেট চেঞ্জ অ্যান্ড এনভায়রনমেন্টাল রিসার্চ (সি৩ইআর) এবং দ্য ল্যানসেট কাউন্টডাউন গ্লোবাল টিম যৌথভাবে এক অনুষ্ঠানের আয়োজন করে। এতে সহযোগিতা করে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের ক্লাইমেট চেঞ্জ অ্যান্ড হেলথ প্রমোশন ইউনিট।

এদিকে বিশ্বব্যাংকের করা অপর একটি জরিপে দেখা গেছে, শারীরিক অসুস্থতার কারণে মানুষ গড়ে বছরে কিছুদিন তাঁদের স্বাভাবিক কাজকর্ম করতে পারেন না। গ্রীষ্মকালে এই কাজ না করতে পারার হার ১ দশমিক ৪ দিন এবং শীতে ১ দশমিক ২ দিন। মানসিক স্বাস্থ্যের কারণে কাজ হারানোর দিন তুলনামূলকভাবে বেশি—শীতে ১ দশমিক ৯ দিন এবং গ্রীষ্মে ২ দশমিক ৩ দিন। তবে গ্রাম ও শহর এলাকার মধ্যে তেমন পার্থক্য পাওয়া যায়নি।

দ্য ল্যানসেট কাউন্টডাউন অন হেলথ অ্যান্ড ক্লাইমেট চেঞ্জ এর প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে বায়ুদূষণকে এখনো অকালমৃত্যুর প্রধান কারণ হিসেবে উল্লেখ করা হয়। ২০২২ সালে মানবসৃষ্ট বায়ুদূষণের কারণে বাংলাদেশে দুই লাখ ২৫ হাজার মানুষের মৃত্যু হয়েছে, যা ২০১০ সালের তুলনায় ২৮ শতাংশ বেশি। ২০২২ সালে মোট বায়ুদূষণজনিত মৃত্যুর ৪১.৫ শতাংশ‌ই (৩০,৬০০ জন) হয়েছে জীবাশ্ম জ্বালানির ক্ষতিকর প্রভাবে। জীবাশ্ম জ্বালানির ৩২ শতাংশ‌ই ছিল বিদ্যুৎ উৎপাদনে কয়লা পোড়ানো।

বিশেষজ্ঞরা বলছেণ, তাপমাত্রা বৃদ্ধির একটি বিরূপ প্রভাব দেশে পড়েছে। গরমের কারণে অসুখবিসুখে তো কর্মঘণ্টা নষ্ট হয়ই। আবার গরম থেকে বাঁচতে যাঁর বৈদ্যুতিক পাখা নেই, তিনি তা কিনতে চান। যাঁর এসি নেই, তিনি এসি কেনেন। এভাবে হয়তো জিডিপিতে ইতিবাচক প্রভাব থাকে; কিন্তু শেষ পর্যন্ত এর নেতিবাচক প্রভাবই বেশি। কারণ, অসুস্থতা বা ক্লান্তিজনিত কর্মঘণ্টা অনেক বেশি নষ্ট হয়ে যায়। আর এটি যে শুধু শ্রমজীবী মানুষের বেলায় ঘটছে তা নয়, সব পেশার মানুষের ক্ষেত্রেই এটা সত্য।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগের অধ্যাপক আবদুস সালাম দীর্ঘদিন ধরে বায়ুদূষণ ও তাপমাত্রা বৃদ্ধি নিয়ে গবেষণা করছেন। তিনি বলেন, তাপমাত্রা বৃদ্ধির মূল কারণ অপরিকল্পিত ও দ্রুত নগরায়ণ ও দূষণ। জনসংখ্যা বেড়ে যাওয়ার কারণে বাংলাদেশে নগরায়ণ হচ্ছে দ্রুত হারে; কিন্তু এর মধ্যে কোনো পরিকল্পনার ছাপ নেই, প্রায় সবই অপরিকল্পিত। ঢাকা ও দেশের অন্যত্র একই চিত্র।

ল্যানসেট কাউন্টডাউনের প্রতিবেদনে বাংলাদেশের তাপপ্রবাহের ভয়াবহ চিত্র উঠে আসে। গত বছর দেশে গড়ে প্রত্যেক ব্যক্তি ২৮.৮ দিন করে তাপপ্রবাহের মুখোমুখি হয়েছে। এর মধ্যে ১৩.২ দিন কেবল জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ঘটেছে। সেই সঙ্গে ১৯৫১ থেকে ১৯৬০—এই ১০ বছরের তুলনায় ২০১৫ থেকে ২০২৪—এই ১০ বছরে সংক্রমণের উপযোগী আবহাওয়া বেড়েছে ৯০ শতাংশ, যা জলবায়ু পরিবর্তনের স্বাস্থ্যঝুঁকি আরো স্পষ্ট করে তুলছে।

অনুষ্ঠানে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন পরিবেশ অর্থনীতিবিদ ও গ্রিনথাম রিসার্চ ইনস্টিটিউটের সিনিয়র ফেলো ড. সৌর দাশগুপ্ত। বার্ষিক এই আন্তর্জাতিক প্রতিবেদনে বিশ্বের ৫০টির বেশি সূচক বিশ্লেষণ করা হয়, যেখানে তাপমাত্রা বৃদ্ধি, বায়ুদূষণ, খরা, রোগের প্রাদুর্ভাব এবং কৃষি ও শ্রমক্ষেত্রে অর্থনৈতিক ক্ষতির তথ্য উপস্থাপন করা হয়।

প্রতিবেদনে আরো বলা হয়, বাংলাদেশে ১৯৯০-এর দশক থেকে তাপপ্রবাহের তীব্রতা ও স্থায়িত্ব দ্রুত বেড়েছে। তাপদাহের কারণে ২০২৪ সালে দুই হাজার ৯০০ কোটি (২৯ বিলিয়ন) সম্ভাব্য কর্মঘণ্টা ক্ষতি হয়েছে, যা ১৯৯০-এর দশকের তুলনায় ৯২ শতাংশ বেশি। এই ক্ষতির সবচেয়ে বেশি বিরূপ প্রভাব পড়েছে দেশের কৃষি খাতে। মোট ক্ষতি হওয়া সময়ের ৬৪ শতাংশই কৃষি খাতের শ্রমিকদের। ফলে বাংলাদেশের সম্ভব্য মোট আয় কমেছে দুই হাজার ৪০০ কোটি টাকা (২৪ বিলিয়ন মার্কিন ডলার), যা দেশের জিডিপির ৫ শতাংশ এবং কৃষি খাতের আয়ের ৫৫ শতাংশের সমান।

প্রতিবেদনে বলছে, ২০১৬ থেকে ২০২২ সালের মধ্যে দেশে জীবাশ্ম জ্বালানি পোড়ানো থেকে কার্বন নিঃসরণ বেড়েছে ৩০ শতাংশ। বাংলাদেশে নবায়নযোগ্য জ্বালানি থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদনের হার এখনো মাত্র ০.৮৫ শতাংশ। ২০২৩ সালে বাংলাদেশ ৮.২ বিলিয়ন মার্কিন ডলার ব্যয় করেছে জীবাশ্ম জ্বালানিতে ভর্তুকির পেছনে, যা কার্বন ট্যাক্স বা নিঃসরণ হ্রাস থেকে অর্জিত যেকোনো লাভের চেয়ে বহুগুণ বেশি।

এ বিষয়ে জানতে চাইরে পরিবেশ অধিদপ্তরের পরিচালক মির্জা শওকত আলী বলেন, ‘আমরা সাভারকে একটি নিয়ন্ত্রিত বায়ুমান অঞ্চল হিসেবে ঘোষণা করেছি, সেখানে কোনো ইট পোড়ানোর সুযোগ দেওয়া হবে না। তাপজনিত চাপ মোকাবেলায় আমরা সিটি করপোরেশন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কাজ করছি।’

ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের জেমস পি গ্র্যান্ট স্কুল অব পাবলিক হেলথের সহযোগী অধ্যাপক ফারজানা মিশা বলেন, ‘জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে স্বাস্থ্য খাতে ঝুঁকি বাড়ছে। ফলে স্বাস্থ্যকে একটি মূল স্তম্ভ হিসেবে স্বীকৃতি দিতে হবে এবং জাতীয় অভিযোজন পরিকল্পনায় অন্তর্ভুক্ত করতে হবে।’

অনুষ্ঠানে বক্তারা নবায়নযোগ্য জ্বালানি, জলবায়ু সহনশীল কৃষি ও বায়ুর মান উন্নয়নে নীতিগত ও আর্থিক বিনিয়োগ বাড়াতে জোর দেন। অনুষ্ঠানে আরো বক্তব্য দেন ঢাকায় নিযুক্ত সুইডেন দূতাবাসের ফার্স্ট সেক্রেটারি নায়োকা মার্টিনেজ ব্যাকস্ট্রম, পল্লী কর্মসহায়ক ফাউন্ডেশনের উপব্যবস্থাপনা পরিচালক ফজলে রাব্বী সাদেক আহমেদ, ইউএনডিপি বাংলাদেশের কান্ট্রি ইকোনমিক অ্যাডভাইজার ওয়াসিস পেরে প্রমুখ।

অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তব্য দেন ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক ড. আইনুন নিশাত। তিনি বলেন, ‘যত দিন যাচ্ছে, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে জনস্বাস্থ্যের ওপর গভীর প্রভাব পড়ছে। গত এক হাজার বছর ধরে যা হয়নি, তা আগামী ৩০ বছরে ঘটবে।’