― Advertisement ―

spot_img

আকাশের শেষ দিগন্তে মা ও ছেলে

বিশেষ প্রতিনিধিঃ

১৯৯৫ সালের গ্রীষ্ম। পৃথিবীর দ্বিতীয় সর্বোচ্চ শৃঙ্গ এবং সবচেয়ে বিপজ্জনক পর্বত কে২-এর হিমশীতল ঢালে তখন এক মৃত্যুর ঝড় জমে উঠছে। সেই মৃত্যুঝড়ের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আছেন একা এক অ্যালিসন হারগ্রিভস — একজন ব্রিটিশ পর্বতারোহী, যিনি তখনই পর্বতজগতের নিয়ম ভেঙে নতুন ইতিহাস গড়েছিলেন।

মাত্র কয়েক মাস আগেই অ্যালিসন বিস্ময়ে মোড়া এক দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন। তিনি একা, কোনো শেরপা সহায়তা ছাড়াই, অতিরিক্ত অক্সিজেন ছাড়া এভারেস্ট জয় করেন। এমন সাফল্য আগে কোনো নারীর ছিল না। এই জয় ছিল নিছক অভিযাত্রা নয়, এক বিপ্লব।

তবুও, অ্যালিসনের সবচেয়ে বেশি সমালোচনা আসে একটি পরিচয়ের কারণে—তিনি ছিলেন একজন মা। সমাজ বারবার তাকে প্রশ্ন করেছে: মা হয়ে এতটা ঝুঁকি নেন কী করে? কিন্তু অ্যালিসনের উত্তর ছিল নিঃশব্দ। তিনি পর্বত জয় করতেন প্রশংসা বা পুরস্কারের জন্য নয়, পর্বত ছিল তাঁর আত্মারই সম্প্রসারণ।

সেই শেষ অভিযান:
১৯৯৫ সালের ১৩ আগস্ট, অ্যালিসন কে২ -এর চূড়ায় পৌঁছান। তারপর শুরু হয় নামার যাত্রা—যেটি হয়ে ওঠে মৃত্যুর পথ।
এক ভয়ংকর ঝড় কে২-কে ঘিরে ফেলে। ১৬০ কিমি বেগে হাওয়া বইতে থাকে, তুষারধস গর্জে নামে।
অ্যালিসনকে শেষবার দেখা যায় শীর্ষ থেকে কিছুটা নিচে। তারপর, নীরবতা। তিনি হারিয়ে যান সেই ঝড়ে। তাঁর দেহ আর কোনো দিন খুঁজে পাওয়া যায়নি। কে২-ই হয়ে ওঠে তাঁর অনন্ত শয্যা।

স্কটল্যান্ডে, একটি ছোট ছেলে অপেক্ষা করছিল। মাত্র ছয় বছর বয়সী টম বলার্ড। অ্যালিসনের ছেলে। সে বড় হয় মায়ের অনুপস্থিতিতে নয়, বরং মায়ের আত্মিক উপস্থিতিতে।
কিন্তু টম শুধু তার মায়ের ছায়ায় হেঁটে বেড়ায়নি। একদিন, সেই ছায়া পেরিয়ে সেও হয়ে ওঠে নিজস্ব এক কিংবদন্তি।

মায়ের মতোই অভিযাত্রী
বছর পেরিয়ে যায়। টম হয়ে ওঠেন এক প্রতিভাবান, সাহসী, আত্মবিস্মৃত পর্বতারোহী।
২০১৫ সালে, তিনি ইতিহাস গড়েন—শীতকালে একাই আল্পস পর্বতমালার ছয়টি ‘গ্রেট নর্থ ফেস’ জয় করেন। এটি ছিল বিশুদ্ধ পর্বতারোহণের এক অনন্য নিদর্শন—যেখানে সাহস ও নৈঃসঙ্গ্য পাশাপাশি হাঁটে। টমের চোখেও সেই একই ডাক—পর্বতের, নিঃসঙ্গতার, এক গভীর নিস্তব্ধতার।
২০১৯ সালে, টম বলার্ড ইতালীয় পর্বতারোহী দানিয়েলে নার্দির সঙ্গে এক বিপজ্জনক স্বপ্নপথে যাত্রা করেন—নাঙ্গা পারবাতের ‘মামারি স্পার’ রুট দিয়ে শীতকালীন অভিযানে। এটি ছিল এক অসমাপ্ত লক্ষ্য, যেটি আগে কেউ সফলভাবে সম্পন্ন করতে পারেনি। ফেব্রুয়ারিতে তারা নিখোঁজ হন। সময় গড়িয়ে যায়।


৯ মার্চ, স্প্যানিশ পর্বতারোহী আলেক্স চিকন ও তাঁর দলের সদস্যরা সেই পাহাড়ের ঢালে দুইজনের নিথর দেহ খুঁজে পান। টমও মায়ের মতোই আর ফিরলেন না।

দুই আত্মা, এক আত্মার ডাক
২৪ বছর ব্যবধানে মা ও ছেলে—দুজনেই প্রাণ হারালেন বিশ্বের সবচেয়ে বিপজ্জনক পর্বতশৃঙ্গগুলোর কোলে।


একজন হারালেন কে২-তে, আরেকজন নাঙ্গা পারবাতে। কিন্তু তাদের গল্প কেবল মৃত্যু বা দুঃখের নয়। বরং এটি সেইসব মানুষের গল্প, যারা জীবনের চেয়ে মুক্তিকে বড় করে দেখেন, যারা জানেন, “মেঘের ওপারে যেখানে আকাশ ছুঁয়ে থাকে, সেখানে একটা পৃথিবী আছে—যেখানে মানুষ প্রকৃত অর্থে মুক্ত।


অ্যালিসন ও টম সেই মুক্তির পথে হেঁটেছিলেন, ভালোবেসেছিলেন, এবং একই আত্মার ডাক শুনে জীবনের চূড়ায় পৌঁছেছিলেন।