ডেস্ক রিপোর্ট : ‘অপহরণ বাণিজ্য’র নিরাপদ আস্তানা হিসেবে কক্সবাজারের সীমান্ত উপজেলা টেকনাফ ও উখিয়ার পাহাড়গুলো কে বেছে নিয়েছে চক্ররা।
শুষ্ক মৌসুম শুরুর পর ‘মহামারি আকারে’ দেখা দিয়েছে অপহরণ ও মুক্তিপণ আদায়।
পাহাড়ের পাদদেশের ফসলি জমি কিংবা পাহাড়ে কাজ করতে যাওয়া শ্রমিক বা খেলারত শিশু এবং মসজিদে যাওয়ার সময়ও অপহরণের শিকার হচ্ছেন স্থানীয় ও রোহিঙ্গারা।
মুক্তিপণ দিতে না পারলে পাচারকারীদের কাছে বিক্রি করে দেওয়া হচ্ছে অপহৃতদের।
শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর আইনশৃঙ্খলার নাজুক পরিস্থিতিতে একের পর এক অপহরণের ঘটনা ঘটেই চলেছে।
ক্রমে এ ঘটনা বাড়লেও স্থায়ী কোন সমাধান মিলছে না।
ভয়ংকর সব পদ্ধতি অবলম্বনে মুক্তিপণ আদায় করছে চক্রটি।
সবশেষ উখিয়ার রোহিঙ্গা ক্যাম্পে ঘরের কাছে খেলারত মুহাম্মদ আরাকান (৭) নামের এক শিশু অপহরণের শিকার হয়।
অপহরণের পর তার গলা পর্যন্ত মাটিতে পুঁতে ভিডিও কলে বাবার কাছে মুক্তিপণ চাওয়া হয়। চক্রটি সাত লাখ টাকা দাবি করে।
পরে দুই লাখ ১০ হাজার টাকা পাঠালে অপহরণের এক সপ্তাহ পর ১৫ জানুয়ারি সকালে জীবিত ঘরে ফেরে শিশুটি।
গত ৮ জানুয়ারি দুপুরের দিকে খেলার সময় তাকে অপহরণ করা হয়েছিল।
আব্দুর রহমান বলেন, ‘তারা পাষাণের মতো আমার সন্তানকে মাটিতে গলা পর্যন্ত পুঁতে ভিডিও করে তা আমাদের কাছে পাঠায়।
সন্তানের বিপদ দেখে মায়ের নাকফুল বিক্রি ও বিভিন্নজনের থেকে ধারদেনায় দুই লাখ ১০ হাজার টাকা তাদের দেখানো মতো স্থানে পাঠানো হয়।
টাকা পেয়ে ছেলেকে হাত-পা বেঁধে কুতুপালং বাজারের পাশে ফেলে যায়।’
গত ১৩ জানুয়ারি প্রতিদিনের মতো মসজিদে ফজরের নামাজে যাওয়ার পথে অপহরণের শিকার হন টেকনাফের হোয়াইক্যংয়ের মিনাবাজার ঘোনাপাড়ার বাসিন্দা শাকের আহমদ (৬০)।
নামাজ শেষ হলেও বাড়ি না ফেরায় স্বজনরা সম্ভাব্য বিভিন্ন স্থানে খোঁজাখুঁজি করেও তার সন্ধান পাননি। রাতে নিখোঁজের স্ত্রীর নম্বরে অজ্ঞাতপরিচয় ব্যক্তি ফোন করে অপহরণের কথা জানান এবং ৫০ লাখ টাকা মুক্তিপণ দাবি করেন।
বিষয়টি পুলিশকে জানানো হয়। ৩২ ঘণ্টার মাথায় ১৪ জানুয়ারি দুপুর আড়াইটার দিকে তাকে ছেড়ে দেয়।
কক্সবাজার জেলা পুলিশ ও ভুক্তভোগীদের দেওয়া তথ্য বলছে, টেকনাফের বাহারছড়া, শামলাপুর, জাহাজপুরা, হ্নীলা, লেদা, মুছনি, রইক্ষং, জাদিমুড়া, হোয়াইক্যং, বালুখালী, থাইংখালী, কুতুপালংসহ আশপাশের এলাকায় প্রায়ই অপহরণের ঘটনা ঘটছে। গত দেড় বছরে টেকনাফ-উখিয়ার বিভিন্ন এলাকা থেকে দুই শতাধিক ব্যক্তি অপহরণের শিকার হয়েছেন। তাদের মধ্যে অর্ধেক রোহিঙ্গা। এসময় অন্তত আড়াই কোটি টাকা মুক্তিপণ আদায় করেছে চক্রটি।
টেকনাফ থানার তথ্যমতে, ২০২৪ সালে অপহরণের মামলা হয়েছে ২০টি। এসব মামলায় উদ্ধার হয়েছেন ৫৭ জন। নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে ৪২টি অপহরণ মামলায় ৮১ ভিকটিমকে উদ্ধার করা হয়েছে। আসামির সংখ্যা প্রায় ৭০। গ্রেফতার হন ২০ জন। মানবপাচার আইনের সাত মামলায় ১৬৮ জন ভিকটিম উদ্ধার এবং ১৬ আসামি গ্রেফতার হন।
টেকনাফ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মুহাম্মদ গিয়াস উদ্দিন বলেন, ‘টাকার লোভে একাধিক রোহিঙ্গা সন্ত্রাসী বাহিনী অপহরণ বাণিজ্যে নেমেছে। স্থানীয় অপরাধীদের সহায়তায় তারা এসব করছে।
অপহরণ করে মুক্তিপণ না পেলে মালয়েশিয়ায় পাচারচক্রের কাছে বিক্রি করে দিচ্ছে। এরইমধ্যে অনেককে আটক ও ভিকটিমদের উদ্ধারে আমরা সক্ষম হয়েছি। বাকিদের ধরতে অভিযান চলমান।’
জেলা পুলিশ সুপার মুহাম্মদ রহমত উল্লাহ বলেন, অপহরণের পর দুর্গম পাহাড়েই ঢুকে পড়েন অপহরণকারীরা।
পুলিশের সেখানে একক অভিযান চালানোর মতো সরঞ্জাম নেই। তাই আমরা যৌথ অভিযান চালাতে জেলা প্রশাসনের সহযোগিতা চেয়েছি।
আশা করছি, খুব শিগগির আমরা একটি সফল চিরুনি অভিযান চালাতে পারবো।
কক্সবাজার র ্যাব -১৫ এর অধিনায়ক লে. কর্নেল এইচ এম সাজ্জাদ হোসেন বলেন, দুর্গম পাহাড়ে র ্যাবের গোয়েন্দা নজরদারি বাড়ানো হয়েছে। বেশ কয়েকটি সফল অভিযানে অনেককে গ্রেফতারও করা হয়েছে। অপরাধীদের বিষদাঁত ভেঙে দেওয়ার প্রচেষ্টা চলছে।
কক্সবাজারের জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ সালাহউদ্দিন বলেন, পাহাড়ে অপহরণ এবং মানবপাচার বন্ধে প্রশাসনের সব সেক্টর যৌথভাবে কাজ করার উদ্যোগ চলছে। পাহাড়বেষ্টিত বিভিন্ন এলাকায় সিসি ক্যামেরা ও পুলিশের চৌকি স্থাপনের কথাও হয়েছে।
বিএম/জ/রা



